তাইফুর রহমান, নলছিটি (ঝালকাঠি) প্রতিনিধি : নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে আক্ষেপ আর কান্নাজড়িত কন্ঠে বেজে ওঠে “কোথাও থাকার জায়গা নাই আমার। আমার মায়ের জমিতে ঘর বানাতে দেয় না ওরা। কেউ অন্য কোথাও থাকতেও দেয় না, পুকুরে জায়গা দিসে, তাই পুকুরে মাচা দিয়ে ঘর বানাইয়া থাকি।”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন অসহায় বিধবা নারী মিনারা বেগম। তার বিয়ে হয়েছিল ফরিদপুরে। স্বামী দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার কারণে সেখানে যা জমি ছিল তা বিক্রি করে তার চিকিৎসা করিয়েছেন। তার বাবার বাড়ি নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের রাজ পাশা গ্রামে। সেখানে তাদের কোনো জমি নাই। তাই মামা বাড়িতে তার মায়ের জমিতে ঘর উত্তোলন করে বসবাস করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মামাতো ভাইয়েরা জমি দিতে চান না। জমি দিলেও পুকুরে নিতে হবে জানালেন। তাই নলছিটি পৌরসভার সবুজবাগ এলাকায় পুকুরের মধ্যে বাঁশ-খুঁটি দিয়ে মাচা তৈরি করে পলিথিন দিয়ে দীর্ঘ তিনমাস ধরে বসবাস করছেন মিনারা বেগম ও তার স্কুল পড়ুয়া নাতি নিরব সরদার।
অসহায় মিনারা বেগম বলেন, আমার স্বামী মইরা গেছে ১৫ বছর হইছে। আমার একটা নাতি আছে, সেও আমার সঙ্গে থাকে। এই নাতিরে লইয়া অনেক কষ্টে দিনযাপন করছি। একটা বাসা ভাড়া নিছিলাম হেয়াও পানিতে তলাইয়া যায়। তাছাড়া আয় রোজগারের কেউ না থাহায় ভাড়া দিতেও পারি না। এর আগে আমার ভাই বাসা ভাড়ার টাকা দিতো, সে এখন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এহন কই যামু, যাওয়ার কোনো পথ দেহি না। মোর মায়ে জায়গা পাইবো মামা বাড়ি। সেই জায়গাটা দেয় না। তিনবছর ধরে মামাতো ভাইগো কাছে ঘুরতে আছি। কিন্তু এরপরও আমারে ঘর বানাইতে দেয় নাই। যখন ঘর বানাতে তাদের কাছে গেছি, আমারে ধাক্কা মাইরা ফালাইয়া দিছে। বাঁশ-খুঁটি ভাইঙা ফালাইয়া দিয়ে ঘর বানাইতে দেয় নাই। এরপর আমার মামাতো ভাই সিদ্দিকুর রহমান বলে, যদি জায়গা নেন তাহলে উপরে দিমু না পুকুরের মধ্যে আছে সেখানে নেন। পরে আমি কি করমু? আমার কপালে আছে এটাই। পরে সবার কাছে চাইয়া বাঁশ-খুঁটি আইনা এই পুহোইরের (পুকুর) মধ্যে মাচা বানাইয়া তিন মাস ধরে নাতিরে লইয়া থাহি।
অসহায় মিনারা বেগম আরও বলেন, আমার কোনো ছেলে সন্তান নাই। একটা মেয়ে আছে তারও জামাই তাকে ছেড়ে দিছে। আমার মেয়ে চিটাগং থাকে। আমি তিনবছর হয়েছে নলছিটিতে এসেছি। মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছে গিয়েছি কিন্তু কোনো কিছুই পাইনি। সরকারি ঘরের জন্য দুইবার আবেদন করেছি কিন্তু তাও কপালে জোটেনি। তাছাড়া বিধবা ভাতার জন্য গেছি তা বলছে কোটা খালি নাই। আমার নাতি নলছিটি মার্চেন্টস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে অনেক কান্নাকাটি করে। ঘর নাই এভাবে থাকা যায় না। পড়াশোনা করতে কষ্ট হয়। ও যে চট্টগ্রাম গিয়ে লেখাপড়া করবে তার মায়ের কাছে, সেখানে অনেক খরচ বেশি। এহন যদি কেউ আমারে সাহায্য সহযোগিতা বা থাকার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে নাতিটাকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারতাম।
নলছিটি পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ও সংবাদকর্মী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, বিধবা ওই নারীকে তার নাতিকে নিয়ে ৩ মাস ধরে এখানে বাঁশ খুঁটি মাচা বানিয়ে পলিথিন দিয়ে ছাউনি দিয়ে পুকুরের ওপর থাকছেন। আসলে মানুষ কতটা অসহায় হলে এভাবে বসবাস করছে তা বলে বুঝাতে পারবো না। আমার কাছে আসলে আমি ফেসবুক লাইভ দিলে বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। ঢাকার জসিম ভাই নামে এক সাংবাদিক তাদের দুইবান টিন কিনে দিয়েছে। আসলে তার দরকার থাকার মতো একটা ঘর।
এ বিষয়ে মিনারা বেগমের মামাতো ভাইদের বাড়িতে না পাওয়ায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
নলছিটি উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী বলেন, মিনারা বেগমের জাতীয় পরিচয় পত্র দেখে তিনি যদি ভাতা পাওয়ার প্রাপ্য হয় তাহলে অবশ্যই ভাতার আওতায় আনা হবে।
নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, মিনারা বেগমের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি ওখানে যাবো গিয়ে তার অবস্থা দেখবো। আর তার জন্য সরকারি সহয়তা করা হবে।